ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) বাড়ছে সংসদীয় ৩০০ আসনের সীমানা পুনর্বিন্যাসের চাপ। এরই মধ্যে ৭৫টি আসন থেকে ইসিতে জমা পড়েছে ৬ শতাধিক আবেদন। এসব আবেদনকারীর বেশির ভাগ ২০০১ সাল পর্যন্ত ৮ম সংসদ নির্বাচনের সময়কার সংসদীয় আসন পুনর্বহালের দাবি করেছেন। একই সঙ্গে যত দ্রুত সম্ভব সীমানা পুনর্বিন্যাসের খসড়া প্রকাশের দাবিও করছেন অনেকে।
২০০১ সালের সীমানা অনুযায়ী মুন্সীগঞ্জ জেলাকে ৪টি সংসদীয় আসনে পুনর্বিন্যাসের দাবিতে গত বুধবার ঢাকায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করেছেন মুন্সীগঞ্জবাসী। এ দাবির পক্ষে ‘মুন্সীগঞ্জ জেলা ৪টি আসন বাস্তবায়ন কমিটি’ এবং ‘মুন্সীগঞ্জ বিক্রমপুর সমিতি’-সহ জেলার রাজনৈতিক, সামাজিক ও পেশাজীবী নেতৃবৃন্দ একত্রিত হয়ে নির্বাচন কমিশনে উপস্থিত হন। স্মারকলিপি প্রদানের পর প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে এক আনুষ্ঠানিক আলোচনায় অংশ নেন প্রতিনিধিদল। পরে তারা নির্বাচন ভবনের বাইরে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন।
প্রতিনিধিদের দাবি, ২০০১ সালের জনসংখ্যা, ভৌগোলিক বিস্তৃতি এবং প্রশাসনিক কাঠামোর ভিত্তিতে মুন্সীগঞ্জে ৪টি আসন পুনঃস্থাপন করা সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। বর্তমান তিনটি আসনে জেলাটির সুষ্ঠু প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হচ্ছে না বলেও উল্লেখ করেন তারা। স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়, মুন্সীগঞ্জ জেলার ইতিহাস, জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও নির্বাচনী ভারসাম্য বিবেচনায় নিয়ে ৪টি আসন বাস্তবায়ন সময়োপযোগী ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অংশ। এ সময় মুন্সীগঞ্জের বিশিষ্ট নাগরিক, পেশাজীবী, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সংশ্লিষ্ট সংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
অপরদিকে একই দিন ঢাকার নির্বাচন কমিশনে গিয়ে বিভিন্ন জেলার বিএনপি নেতারা সংসদীয় আসনের সীমানা ২০০১-এর মতো বহাল রাখার পক্ষে এবং এ-সংক্রান্ত খসড়া দ্রুত প্রকাশের দাবি জানিয়েছেন। এর আগে দুপুরে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিনের সঙ্গে তারা বৈঠক করেন।
সিইসির সঙ্গে বৈঠকের পর কুমিল্লার সাবেক এমপি ও বিএনপি নেতা মনিরুল হক চৌধুরী বলেন, আমরা চাই ১৯৮৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত যেভাবে সীমানা ছিল, সে অনুযায়ী সীমানা নির্ধারণ করা হোক। এটা আমাদের সর্বজনীন দাবি। কমিশনের কাছে দ্রুত খসড়া তালিকা প্রকাশের আবেদন করেছি। কমিশন জানিয়েছে, তারা কাজ করছে। আশা করি, আমাদের প্রত্যাশা পূরণ হবে। আর সেটা করলে নির্বাচন কমিশনও প্রশ্নবিদ্ধ হবে না।
এর আগে হোমনা ও মেঘনা উপজেলা নিয়ে গঠিত কুমিল্লা-২ আসনটি আগের মতো রাখার দাবিতে নির্বাচন কমিশন ভবনের সামনে মানববন্ধন করে ওই আসনের আবেদনকারী ও স্থানীয় জনতা। তারা বলেন, ১৯৫৪ সাল থেকে হোমনা-মেঘনা এক আসন ছিল। কিন্তু ২০০৮ সালের তৎকালীন নির্বাচন কমিশন এটি আলাদা করে। ২০১৮ সালের নির্বাচন পর্যন্ত সেভাবেই ভোট হয়। ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে কুমিল্লা-২ আসনটি ফের আগের মতো করা হয়।
স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত সীমানা নির্ধারণ নিয়ে তেমন কোনো বিতর্ক ছিল না। ২০০৮ সালে বাংলাদেশের সংসদীয় আসনের সীমানায় ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়, যা দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যাপকভিত্তিক সীমানা পুনর্নির্ধারণের কাজ। সে সময় সীমানা নির্ধারণে জনসংখ্যার ঘনত্বকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এই সীমানা নির্ধারণ নিয়ে বিতর্ক ওঠে। তখন দুই বছরের সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ব্যাপক সংস্কার আনা হয় নির্বাচনী সব আইনে, যার ধারাবাহিকতা এখনো অব্যাহত। ২০১৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনের সময় কোনো জেলার আসনসংখ্যা দুটির কম হবে না, পার্বত্য ৩ জেলায় একটি করে এবং ও ক্ষুদ্র জেলা মেহেরপুরে ২টি আসন বরাদ্দ রাখা হয়। আর ঢাকায় আসন বাড়িয়ে ১৩টি থেকে ২০টি করা হয়।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, সীমানাসংক্রান্ত সংশোধন অধ্যাদেশ হাতে পাওয়ার পর এ বিষয়ে কাজ করেছে ইসির সংশ্লিষ্ট কমিটি। কমিশনে জমা পড়া ৬ শতাধিক আবেদন তারা পর্যালোচনা করছেন। সংসদীয় এলাকার জিআইএস-সংক্রান্ত (জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেম) পূর্ণাঙ্গ উপাত্ত না পাওয়ায় এ ক্ষেত্রে ইসি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। সবশেষ ১৯ জুন নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ জানান, সময়ের অভাবে এবং কিছু উপাত্তের অভাবে কাজ এগিয়ে নিতে তাদের অসুবিধা হচ্ছিল। সম্প্রতি সে বিষয়ে অগ্রগতি হওয়ায় এ পর্যায়ে তারা দ্রুত কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন।
এদিকে ড. বদিউল আলম মজুমদারের নেতৃত্বাধীন নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনও ২০০৮-২০২৩ সালের সীমানা নির্ধারণে বিতর্কের বিষয়টিও তুলে ধরেছে। সংস্কার কমিশনের সদস্যরা বলেন, ২০০১ সালের নির্বাচনের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে সীমানা নির্ধারণ নিয়ে বিশেষ কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। ২০০৮ সালে ব্যাপকভিত্তিক সীমানা পুনর্নির্ধারণের সময় জাতিসংঘের সহায়তায় একজন আন্তর্জাতিক সীমানা নির্ধারণ বিশেষজ্ঞকে নিয়োগ দিয়ে একটি গবেষণা করা হয়, যদিও ওই গবেষণার সব পরামর্শ গ্রহণ করা হয়নি।
‘জাতীয় সংসদের নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫’-এর খসড়ায় নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. তোফায়েল আহমদ বলেন, সীমানা নির্ধারণে নির্বাচনের ফল অনেকটাই প্রভাবিত হয়। আইনগতভাবে সীমানাবিন্যাসের বিষয়টি ইসির এখতিয়ার। এ কারণে ইসির এ বিষয়ে কালক্ষেপণের সুযোগ নেই। কারণ ফেব্রুয়ারিতে ভোট করতে হলে প্রার্থীদের সময় দিতে হবে। তারা যদি সীমানা পরিবর্তন না করে, কেন করা সম্ভব হলো না- সেটা জানিয়ে ব্যাখ্যা দিতে হবে, কালক্ষেপণ করলে ইসির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

পুনর্বিন্যাসের চাপে ইসি
- আপলোড সময় : ২৭-০৬-২০২৫ ০১:১০:০২ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ২৭-০৬-২০২৫ ০১:১০:০২ অপরাহ্ন


কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ